
আশিক বিল্লাহ,. লালমনিরহাট, কালীগঞ্জ
শিক্ষার্থী, আইন ও মানবাধিকার বিভাগ,ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক।
বাংলাদেশে স্বাধীন মত প্রকাশ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মৌলিক মানবাধিকার, যা তাদের চিন্তা, বিবেক ও জ্ঞানচর্চাকে বিকশিত করে।
বিশেষ করে একাডেমিক বিকাশ, সামাজিক অংশগ্রহণ এবং গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তবে স্বাধীন মত প্রকাশ পরম নয়;আইন সর্বত্রই এ অধিকারকে সর্বক্ষেত্রে স্বীকার করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে।
শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সাংবিধানিক ভিত্তি রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ -৩৯ অনুযায়ী :প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তা, বিবেক, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে।
যার ফলে একজন শিক্ষার্থী :
১।নিজের মতো করে চিন্তা, বিশ্লেষণ ও মতামত গঠন করার অধিকার রাখে।
২।কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ইস্যুতে ভিন্নমত রাখতে পারে।
৩।ছাত্র সংগঠন বা সাংস্কৃতিক ফোরামের মাধ্যমে মতামত প্রকাশ করতে পারে।
৪।শিক্ষা নীতি,প্রশাসন, শিক্ষক বা রাষ্ট্রের নীতি নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার রাখতে পারে।
৫।ক্লাসরুমে মুক্ত আলোচনা,বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ পত্রিকা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবন্ধ, নিবন্ধ বা সমালোচনা প্রকাশ করার অধিকার
শিক্ষার্থীদের রয়েছে।
৬।শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল, মানববন্ধন বা প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে মত প্রকাশ করতে পারে।
তবে উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে,
“রাষ্ট্রের নিরাপত্তা,জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা, শালীনতা, আদালত অবমাননা বা মানহানি রোধ করার স্বার্থে যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে সংবিধানে অধিকারগুলো দেয়া হয়েছে”
আসুন আমরা একটু আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো থেকে ঘুরে আসি,
শিক্ষার্থীদের স্বাধীন মত প্রকাশ শুধু জাতীয় নয়, বরং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
১।যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান,প্রথম সংশোধনীতে(First Amendment) বলা হয়েছে – যুক্তরাষ্ট্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সর্বাধিক সুরক্ষিত। শিক্ষার্থীরাও প্রায় সীমাহীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারে। তবে সহিংসতায় উস্কানি (incitement of violence)বা বিদ্বেষ মূলক বক্তব্য (hate speech) প্রকাশের অনুমতি শিক্ষার্থীদের দেয়া হয়নি ।
২। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা :
Universal Declaration of Human Rights(UDHR), অনুচ্ছেদ ১৯ এ বলা হয়েছে,প্রত্যেক মানুষের মতামত ও অভিব্যক্তির স্বাধীনতা রয়েছে। অর্থাৎ কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই মতামত পোষণ করা, তথ্য ও ধারণা অনুসন্ধান, গ্রহণ ও প্রচার করার অধিকার সবার রয়েছে।
৩।ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশন
European Convention on Human Rights (ECHR) অনুচ্ছেদ ১০ এ বলা হয়েছে, মানুষের( শিক্ষার্থীদের) অভিব্যক্তির স্বাধীনতা রয়েছে। তবে এটি আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ হতে পারে, যদি তা জাতীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা বা অন্যের অধিকার রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় হয়।
আসুন আমরা একটি মামলা পড়ি
মামলাটির নাম (ওমুর চাগদাশ এরসয় বনাম. তুরস্ক)(Omur Cagdas Erosy vs.Turkey)২০১২ সালে তুরস্কের শিক্ষার্থী ওমুর চাগদাশ এরসয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছিলেন। প্রথমে তাকে আঙ্কারা ক্রিমিনাল কোর্টে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পরে মামলাটি ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত (ECHR)-এ গিয়ে পৌঁছায়। ECHR রায় দেয়, সেই শিক্ষার্থীর মন্তব্য জনস্বার্থের আলোচনার অংশ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধীনে সুরক্ষিত।
এই মামলা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে-শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক বা জনস্বার্থমূলক সমালোচনা শান্তিপূর্ণ এবং যুক্তিপূর্ণ হলে তা মত প্রকাশের স্বাধীনতার আওতায় সুরক্ষিত, যদিও জাতীয় আইন কখনো সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই,বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে ।শিক্ষার্থীরা যদি এই অধিকারকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারে, তবে তারা শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক মানবাধিকার চর্চার অংশীদার হয়ে উঠবে। স্বাধীনতার সমন্বয়েই গড়ে উঠবে কাঙ্ক্ষিত সমাজ, যেখানে জ্ঞান, যুক্তি ও নৈতিকতা মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।