
মুহিব্বুল্লাহ আজাদ মহিব: বাংলাদেশ জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ছায়াতলে আয়োজিত ১৪ দিনের “মাল্টিমিডিয়া ডিজাইন” কোর্সটি কেবল একটি প্রশিক্ষণ ছিল না, এটি ছিল আমাদের ৩৪ জন স্বপ্নবাজ তরুণের মিলনমেলা। এই চৌদ্দটি দিন যেন আমাদের জীবনের ক্যানভাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে দিয়ে গেল, যেখানে রং-তুলির আঁচড়ে আঁকা হয়েছে বন্ধুত্ব, জ্ঞান আর অজস্র মধুময় স্মৃতি।
দিনগুলো শুরু হয়েছিল মাল্টিমিডিয়ার জটিল সব সফটওয়্যার আর ভিডিও এডিটিং এর কলাকৌশল শেখার মধ্য দিয়ে। সময়ের সাথে সাথে সেই ডিজিটাল ক্যানভাসের পাশাপাশি আমাদের হৃদয়ের ক্যানভাসেও ফুটে উঠতে শুরু করে এক অন্যরকম ছবি। প্রতিটি ক্লাসের ফাঁকে, চায়ের কাপে কিংবা একসাথে খাবার ভাগ করে নেওয়ার মুহূর্তে আমরা একে অপরের হয়ে উঠেছিলাম পরমাত্মীয়। আমাদের এই পথচলায় আলোকবর্তিকা হয়ে ছিলেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ, যাদের স্নেহমাখা শাসন আর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আমাদের মুগ্ধ করেছে। তাদের আন্তরিক শেখানোর ভঙ্গিতে কঠিন বিষয়গুলোও হয়ে উঠেছিল সহজবোধ্য।
আমাদের মাল্টিমিডিয়া ডিজাইন কোর্সের পাশাপাশি আরও তিনটি কোর্স— ক্ষুদ্র ব্যবসা ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন, যুব নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণ— একই সাথে চলছিল। ফলে ইনস্টিটিউটের করিডোর, ক্লাসরুম আর সবুজ চত্বর মুখরিত ছিল শতাধিক নবীন মুখের পদচারণায়। সেখান থেকেও অনেকের সাথে গড়ে উঠেছিল মধুর সম্পর্ক। বিভিন্ন কোর্সের শিক্ষার্থীদের সাথে ভাবনার আদান-প্রদান আমাদের জগতকে করেছিল আরও বিস্তৃত।
আমাদের ৩৪ জনের “মাল্টিমিডিয়া ডিজাইন” ব্যাচটি ছিল যেন একটি পরিবার। হাসি-ঠাট্টা, ক্যাম্পাসে ঘুরাঘুরি, গ্রুপে আড্ডা —এই সবই আমাদের বেঁধেছিল এক অটুট বন্ধনে। নরমাল ভিডিও এডিটিং থেকে শুরু করে প্রফেশনাল ভিডিও এডিটিং, এনিমেশন, অডিও এডিটিং, ২ ডি ও ৩ ডি এনিমেশন ব্লেন্ডারের নতুন নতুন কৌশল আয়ত্ত করা, প্রতিটি কাজেই ছিল সম্মিলিত প্রচেষ্টা। বিদায়ের সুর যখন বেজে উঠল, তখন উপলব্ধি হলো, এই ১৪ দিনে আমরা কেবল একটি কোর্স সম্পন্ন করিনি, আমরা অর্জন করেছি এক জীবনের সঞ্চয়— কিছু অমূল্য বন্ধু আর একরাশ স্মৃতি।
আজ এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই দিনগুলোর খণ্ডচিত্র। বন্ধুদের প্রাণবন্ত আড্ডা, শিক্ষকদের অমূল্য দিকনির্দেশনা আর ইনস্টিটিউটের সেই মায়াবী পরিবেশ— সবই অমলিন হয়ে আছে স্মৃতির পাতায়। আর জীবনের যেকোনো বাঁকে, যেকোনো সময়ে এই স্মৃতিগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেবে এক অসাধারণ সময়ের কথা, যখন আমরা ৩৪ জন এক সুতোয় বাঁধা পড়েছিলাম। বাংলাদেশ জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সেই চৌদ্দটি দিন কেবল একটি মাল্টিমিডিয়া ডিজাইন কোর্স ছিল না, ছিল আমাদের ৩৪টি স্বতন্ত্র সত্তার এক হয়ে ওঠার জাদুকরী অধ্যায়। দুই সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত সময়, কিন্তু এর ক্যানভাসে যে বন্ধুত্বের আলপনা আঁকা হয়েছে, তার গভীরতা যেন সমুদ্রের। আজ যখন স্মৃতির জানালা খুলে বসি, সেই মুখগুলো, সেই মুহূর্তগুলো এক অনবদ্য আলোর মিছিল হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
অদৃশ্য পদচিহ্ন
চেনা পথের ধুলোয় লেগে আছে স্মৃতির ঘ্রাণ,
প্রতিটা মুখ, প্রতিটা কোণ— হৃদয়ের অম্লান।
যেখানে ছিল হাসির ঝিলিক, অনুরণিত গান,
সেখানেই আজ বিদায়ের ফিকে রঙে ম্লান।
চোখের কোণে অশ্রু জমে, মন মানে না যেতে,
বন্ধুরা সব মিলিয়ে যায় দূর দিগন্তে।
রয়ে যায় শুধু কিছু কথা, কিছু ছবি, আর দীর্ঘশ্বাস,
এই পথের বাঁকেই যেন থমকে থাকে বিশ্বাস।
আমাদের এই যাত্রাপথকে সার্বক্ষণিক প্রাণবন্ত করে রেখেছিল কয়েকটি চরিত্র। হাসির অফুরন্ত ঝরনাধারা হয়ে ছিল বিমল রায়, যার নির্মল কৌতুক আর সরস উক্তিতে পুরো ক্লাস ভেসে যেত অনাবিল আনন্দে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে আড্ডাকে জমিয়ে রাখত রসিক জুবায়ের; তার মনখোলা উপস্থিতি আর উচ্ছলতা আমাদের মুহূর্তগুলোকে আরও রঙিন করে তুলত। আর এই প্রাণশক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আমাদের সাংবাদিক আনছারুজ্জামান, সবার প্রিয় রেজওয়ান ভাই। তার উদ্যম, সবাইকে আগলে রাখার প্রয়াস আর নেতৃত্বগুণে সে ছিল একাই একশো। তার দুষ্টুমি কথাবার্তা আর প্রাণবন্ত উপস্থিতি ছাড়া কোর্সটি হয়তো পূর্ণতা পেত না।
দায়িত্ববোধ আর আত্মবিশ্বাসের এক দারুণ প্রতিচ্ছবি ছিল সাজ্জাদ। যেকোনো কাজে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আর সবকিছুতে নিজের সেরাটা দেওয়ার প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়। তার নিজেকে প্রকাশ করার স্বতন্ত্র ভঙ্গিটা ছিল তার আত্মবিশ্বাসেরই পরিচায়ক। অন্যদিকে, অমায়িক ব্যবহারের মূর্ত প্রতীক ছিল নূরসাদ ভাই। প্রতিভার বিন্দুমাত্র অহংকার তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তার সহজ-সরল হাসি আর নিঃস্বার্থভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার গুণে সে সবার হৃদয়ে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল।
বন্ধুত্বের কথা উঠলে যার নামটি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করতে হয়, সে হলো মাসুদ ভাই। তার আন্তরিক ব্যবহার আর মিশুক স্বভাবের কারণে সে হয়ে উঠেছিল আমার প্রিয় বন্ধু, এককথায় আস্থার প্রতিশব্দ। তেমনই আরেকজন অনন্য মানুষ ছিল নাঈমুল ইহসান । তার স্বতন্ত্র গোঁফ, মজাদার সব মন্তব্য আর গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তাকে সবার মাঝে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিল। তার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শেখার আর নিখাদ আনন্দের।
আমাদের এই পরিবারে প্রতিটি সদস্যই ছিল একেকটি স্বতন্ত্র নক্ষত্র। ক্লাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের একজন ছিল আমার রুমমেট সাইফুর রহমান। অসাধারণ প্রতিভা আর জ্ঞানের গভীরতা নিয়েও সে ছিল অবিশ্বাস্য বিনয়ী আর প্রচারবিমুখ। নিজের কাজের প্রতি তার একনিষ্ঠতা এতটাই প্রবল ছিল যে, পারিপার্শ্বিক কোলাহল তাকে স্পর্শ করত না। ইউরোপের কোনো এক উন্নত দেশে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে বিভোর এই মানুষটা ছিল এক চলমান রহস্য। মজার ব্যাপার হলো, সে আমার রুমমেট হলেও একরাতের জন্যও রুমে তার পদধূলি পড়েনি। এমন একজন জিনিয়াসের সান্নিধ্য পাওয়া ছিল আমাদের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
আমার আরেক রুমমেট ফরিদ হয়তো নিজের জগতেই থাকতে ভালোবাসত, শাঈমার প্রতি তার টান ছিল অকৃত্রিম। সারাদিন পরিজনদের সাথে যোগাযোগে ব্যস্ত থাকলেও, দিনশেষে আমাদের এই চৌদ্দ দিনের স্মৃতির সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালাটা কিন্তু তারই তৈরি। তার ক্যামেরায় ধারণ করা ছবিগুলোই আজ আমাদের স্মৃতির সবচেয়ে বড় দলিল।
মেয়েদের মাঝে ছিল সৌন্দর্যের স্নিগ্ধ প্রতিনিধি চুমকি, যার মার্জিত উপস্থিতি ও মিশুক স্বভাব সবারই ভালো লাগত। তার পাশাপাশি ছিল তানিতা— একদমই শান্ত, নম্র আর লাজুক এক বালিকা। তার নীরবতাও যেন তার ব্যক্তিত্বের এক স্নিগ্ধ অলংকার ছিল। *শিউলি*র মিষ্টি হাসি আর আন্তরিকতা যেকোনো পরিবেশকে সহজ করে তুলত। তার সাথে কথা বললে মনে হতো, সে যেন কতদিনের চেনা।
আমাদের এই বহুবর্ণী পরিবারে শাঈমা ছিল এক স্বতন্ত্র ও কিছুটা রহস্যময় চরিত্র। সে নিজেকে সবসময় একটু আলাদাভাবে উপস্থাপন করতো। তার চালচলনে সব সময় এক ধরনের ভাব বা দূরত্ব থাকত, যা তাকে সবার থেকে আলাদা করে রাখত। তার সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক ছিল, ক্লাসের কাজে খুব বেশি সক্রিয় না থেকেও এমনকি পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও ফলাফলের তালিকায় তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। এই বিষয়টা আমাদের মধ্যে এক মজার আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। সব মিলিয়ে, তার এই ভিন্নধর্মী ব্যক্তিত্ব আমাদের চৌদ্দ দিনের গল্পের ক্যানভাসে এক অন্যরকম আঁচড় রেখে গেছে।
ফ্যাশন সচেতন ও উদ্যমী মাহফুজা মিতু ছিল ক্লাসের আরেক আকর্ষণ। কম্পিউটারের সাথে ভালোভাবে পূর্বপরিচয় না থাকলেও, তার শেখার আগ্রহ ছিল প্রবল। সেই আগ্রহ থেকেই সে বারবার আমার সাহায্যপ্রার্থী হতো, আর তার সেই আবদারগুলো পূরণ করার মুহূর্তগুলো এখন এক মধুর স্মৃতি হয়ে মনে দোলা দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে চলা *মিশু*র স্মার্ট বাহ্যিক রূপের আড়ালে ছিল এক দারুণ আন্তরিক ও অমায়িক মন। সে মিশতে জানে, অন্যকে গুরুত্ব দিতে এবং তার সুন্দর ব্যবহার দিয়ে সহজেই আপন করে নিতে জানে। একারণেই তার স্মার্ট হতে চাওয়ার চেষ্টার চেয়েও তার সহজ ও সুন্দর মনটা বেশি স্পর্শ করেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক উজ্জ্বল প্রতিনিধি ছিল সুমাইয়া আপু। তার সপ্রতিভ ও মার্জিত উপস্থিতির পেছনে প্রথমদিকে ছিল এক ধরনের গাম্ভীর্যের আবরণ, কিন্তু দিন গড়ানোর সাথে সাথে সেই আপাত দূরত্বের বরফ গলে বেরিয়ে আসে এক দারুণ মিশুক ও যত্নশীল সত্তা। আর তার স্বতন্ত্র পারফিউমের ঘ্রাণটা ছিল তার উপস্থিতির মতোই প্রখর ও অবিস্মরণীয়, যা ছিল তারই ব্যক্তিত্বের মতো প্রখর। সেই স্বতন্ত্র সুবাসটি আমার কাছে কিছুটা অসহনীয় ঠেকলেও সেটাই ছিল তার পরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সে সবার খোঁজখবর রাখতে জানে, আর আমার প্রতি তার যে একটি ইতিবাচক ধারণা ছিল, তা তার আচরণে প্রকাশ পায়। তার আন্তরিকতা আমাদের চৌদ্দ দিনের বন্ধুত্বকে আরও গভীর করে তুলেছিল।
দুই সন্তানের জননী সাবিহা আপু ছিল আমাদের মাঝে ধৈর্য ও কর্তব্যের এক দারুণ উদাহরণ। তার পরিমিত কথা আর গাম্ভীর্যের মাঝেও লুকিয়ে ছিল এক স্নেহময়ী রূপ। অন্যদিকে ফারজানা ছিল স্বল্পভাষী ও শান্ত প্রকৃতির, কিন্তু তার সাথে কথা বললে তার চিন্তার গভীরতা অনুভব করা যেত। ক্লাসের সবচেয়ে ছোট্ট সদস্য ছিল নিভা; ক্লাসরুমে তার উপস্থিতি ছিল স্নিগ্ধ, শান্ত ও বিনম্র। সামনাসামনি হয়তো সে কিছুটা স্বল্পভাষী, চুপচাপ থাকলেও মেসেজে তার সরব উপস্থিতি আর আন্তরিকতা ছিল লক্ষণীয়। তার এই শান্ত বাহ্যিক রূপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এমন এক প্রাণবন্ত ডিজিটাল সত্তা আমাদের শিখিয়েছে যে, মানুষের গভীরতা সবসময় চোখে দেখা যায় না; কখনও কখনও তা অনুভব করতে হয় অক্ষরের বুননে।
আমাদের মাঝে বয়োজ্যেষ্ঠ ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন মাহবুব ভাই। তার উপস্থিতি আমাদের এই তরুণদের দলে এক ধরনের অভিভাবকত্বের ছায়া দিত। টেকনিক্যাল বিষয়গুলো তার জন্য নতুন হলেও, শেখার প্রতি তার আগ্রহ আমাদের জন্য ছিল অনুপ্রেরণার। আর ছিল আমাদের স্বপ্নবাজ আ. কাইয়ুম, সেরা হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যার চোখেমুখে ফুটে উঠে ছিল। আশাকরি তার এই স্পৃহাই একদিন তাকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যাবে।
আমাদের মাঝে জ্ঞানের প্রতি অদম্য কৌতূহল নিয়ে উপস্থিত ছিল পিয়াস ভাই। তার বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নগুলো প্রায়ই আমাদের ভাবনার জগৎকে আরও প্রসারিত করে দিত। তবে তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল তার বাচনভঙ্গি। তার পরিমিত ও শান্ত কণ্ঠের কথাগুলো আমায় মুগ্ধ করত।
কিছু মুখ ছিল যারা নিজেদের নিভৃত জগতে থেকেও আমাদের এই পরিবারের অংশ ছিল। জোনায়েদ ভাই ছিল তেমনই একজন লাজুক ও অমায়িক মানুষ। তার শান্ত স্বভাব আর মৃদু হাসি শেষের দিকে আমার হৃদয়ে গভীর মায়া তৈরি করে দিয়ে চলে গেল। আর আমাদের ছিল লিংকন বিশ্বাস। প্রথমদিকে সে ছিল শান্ত এক হ্রদের মতো, নিজের চারপাশে নীরবতার এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে রাখত। ক্লাসের কোলাহলে সে ছিল এক নিবিষ্ট শ্রোতা, কিন্তু কোর্স যখন শেষের পথে, বিদায়ের সুর যখন বাজতে শুরু করল, তখন সেই শান্ত হ্রদেই যেন আবেগের উত্তাল ঢেউ উঠল। তার পাঠানো আবেগঘন বার্তাগুলো ছিল জমাট বাঁধা অনুভূতির এক আশ্চর্য প্রকাশ। তার প্রতিটি শব্দ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, এই চৌদ্দ দিনের মায়া তাকে কতটা গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। যে মানুষটা সবচেয়ে চুপচাপ ছিল, বিদায়বেলায় তারই ভেতরের আবেগটুকু সবচেয়ে বেশি নাড়িয়ে দিয়েছিল।
আর ছিল সজল, যে ছিল সম্পূর্ণ নিজের ভুবনের বাসিন্দা। তার কাজগুলো হয়তো আমাদের কাছে দুর্বোধ্য ছিল, কিন্তু এখন মনে হয়, প্রতিটি মানুষই তো নিজের মতো করে পৃথিবীকে দেখে। সজলও হয়তো তার নিজস্ব ক্যানভাসে আমাদের এই সময়টাকে এঁকে রেখেছিল ভিন্ন কোনো রঙে।
এই বর্ণিল মুখগুলোর ভিড়ে আমি মুহিব ও ছিলাম। সবার সাথে মিশে, ছবি তুলে, স্মৃতিগুলোকে এক সুতোয় বাঁধার চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে সবার প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোর যে আনন্দ, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
চৌদ্দ দিনের এই যাত্রাপথে কিছু মানুষের সাথে পরিচয় ছিল অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের মতো, যা আমাদের অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল। যে আবু সাঈদ ছিল শান্ত হ্রদের মতো স্থির, ফলাফল প্রকাশের দিনে আমরা আবিষ্কার করলাম সেই স্থিরতার গভীরে লুকিয়ে ছিল এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। তার প্রথম স্থান অর্জনের মধ্য দিয়ে আমরা কেবল একজন বিজয়ীকে খুঁজে পাইনি, খুঁজে পেয়েছিলাম এক নীরব সাধকের ভেতরের প্রতিভার আসল পরিচয়।
তেমনিভাবে রবিউল ভাই এর মাঝে ছিল কিছু করে দেখানোর চেষ্টা আর তার ধার্মিক সত্তার এক শান্ত প্রকাশ। তার নিরলস প্রচেষ্টা আর নামাজের ইমামতিতে দাঁড়িয়ে যাওয়া—এই সবই ছিল তার শান্ত ধার্মিক সত্তার এক নির্মল প্রতিচ্ছবি। আর জসিম ভাই ছিল তার শুভ্র লেবাসের মতোই এক নির্মল চরিত্র। তার মিতভাষণ বা নীরবতা ছিল তার ব্যক্তিত্বের অলংকার, যা তাকে হৈ-হুল্লোড়ের মাঝেও এক স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছিল।
আর আমার জন্য রাসেলের সাথে পরিচয়টা ছিল যেন পূর্বনির্ধারিত কোনো এক মধুর সমাপতন। একই জেলা, একই কর্মস্থলের অতীত— এই অপ্রত্যাশিত যোগসূত্রটা আমাদের দুই সপ্তাহের পরিচয়কে নিমেষেই এক গভীরতর অনুভবে পৌঁছে দিয়েছিল।
সব বাগানেই কিছু ফুল থাকে যা সবার নজর কাড়ে, আবার কিছু ঘাস বা শান্ত লতাগুল্ম থাকে যা পুরো বাগানকে শ্যামল রাখে। আমাদের এই পরিবারের মজবুত ভিত্তিও গড়ে দিয়েছিল তেমনই কিছু সুন্দর মনের মানুষ, যারা হয়তো সবসময় আলোচনার কেন্দ্রে থাকত না, কিন্তু তাদের উপস্থিতিই ছিল আমাদের সম্পর্কের মূল শক্তি।
আমাদের এই পরিবারের মজবুত ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল আরও কিছু শান্ত, সুন্দর মনের মানুষ। তাদেরই অমায়িক ব্যবহারের এক স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল জামাল। যার সাথে কথা বললেই মনটা ভালো হয়ে যেত অনায়াসে। সবার সাথে সহজভাবে মিশে যাওয়ার দারুণ ক্ষমতা ছিল হাবিবের; সে ছিল আমাদের দলের এক অবিচ্ছেদ্য ‘নিরামিষ’ পদের মতো, যার সহজলভ্যতা আর সবার সাথে অনায়াসে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা এই বৈচিত্র্যময় আড্ডাকে এক সুতোয় বেঁধে রেখিছিল।
খুব বেশি মেশার সুযোগ না হলেও ইসমাইলের চোখেমুখে যে আন্তরিকতার আভাস মিলত, তাতেই তার সুন্দর মনটার পরিচয় পাওয়া যেত। তেমনই আরেক নিরব শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল সাফিন ভাই, যার পরিমিত ও শান্ত উপস্থিতিই বলে দিত সে এক সজ্জন মানুষ।
আজ আমরা দূরে, কিন্তু সেই চৌদ্দ দিনের স্মৃতি আমাদের খুব কাছে। বাংলাদেশ জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট আমাদের কেবল একটি সনদ দেয়নি, দিয়েছে এক জীবনের পাথেয়— একদল বন্ধু আর একরাশ সোনালি স্মৃতি। এই বন্ধুত্ব অটুট থাকুক, আমাদের এই চৌদ্দ দিনের গল্প চিরসবুজ থাকুক স্মৃতির ক্যানভাসে।
বিদায় নয়, দেখা হবে… স্মৃতির অন্য প্রান্তে।
শূন্য চত্বর, নীরব করিডোর, বিদায় নিয়েছে সুর,
বন্ধু নামের সেই মিছিল আজ চলে গেছে বহুদূর।
কারো কাঁধে ব্যাগের ভার, কারো চোখে জল,
থমকে আছে সময়, শূন্যতা শুধু অবিরল।
চায়ের কাপে জমে আছে শেষ চুমুকের তৃষ্ণা,
দেয়ালে আঁকা স্মৃতিগুলো আজ শুধুই স্পর্শহীন ছবি।
যেখানে ছিল হাসির ফোয়ারা, কথার ফুলঝুরি,
সেখানেই আজ শূন্যতা শুধু, মনটা নিচ্ছে চুরি।
অক্ষরগুলো হারিয়ে গেছে, জমেছে দীর্ঘশ্বাস,
বুকের ভেতর পুষে রাখি ফিরে পাওয়ার বিশ্বাস।
বিদায় তো নয়, এই তো শুরু নতুন কোনো গাথা,
অন্তরালে হয়তো আবার মিলবে সব কথা।
দেখা হবে বন্ধু আবার, কথা দিলাম আজ,
স্মৃতির ক্যানভাসে আঁকবো আমরা নতুন কোনো রাজ।
ততদিন ভালো থাকো, যে যেখানেই থাক,
মনের মণিকোঠায় এই দিনগুলো চিরকাল জ্বালাক।