সংবাদিকতা একটি কঠিন ও মহান পেশা। এ পেশাকে মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এ পেশার লোকজনকে অনেকেই জাতির বিবেক বলে থাকেন। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতার সাবলীল মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। শুধু দেশ,জাতি নয়,বিশ্ব উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও সাংবাদিকদের অগ্রণী ভূমিকা দেশে দেশে স্বীকৃত। সাধারণ জনগণের এ মহান পেশার প্রতি প্রগাঢ় আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। কারণ এ সমাজের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তরবারির ন্যায় কলমের শানিত অস্ত্র একমাত্র সাংবাদিকরাই ধরে থাকেন। বিভিন্ন ধরনের ঘটনা প্রবাহের সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি পত্রিকার মাধ্যমে দেশের বর্তমান অবস্থা ও করণীয় বিষয়ও অহরহ দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। তাই তো প্রকৃত সাংবাদিকের কোন দেশ কাল পাত্র নেই। তারা জগৎ সভার এক একজন পরীক্ষক ও নিরীক্ষক। সামাজিক অনাচার ও বৈপরিত্যের বিরুদ্ধে সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা, মানবতার অতন্দ্র প্রহরী সাংবাদিকরা দেশ ও জাতির শেষ ভরসা। তাদের তৃতীয় নয়ন সব সময় অপঃরাব চোখ হয়ে ঘটনার গভীরে গিয়ে সত্য উদ্ঘাটনে পারঙ্গম হবে এটাই পাঠক সমাজ আশা করে।
সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকরা এসব কিছু মোকাবিলা করেই তাদের পেশার সম্মানকে অমলিন করে রাখছেন। এ পেশা মূলতঃ শুধু জীবিকার মাধ্যম নয়, দেশ-জাতি এবং মানুষ ও মানবতার কল্যাণে সেবার মাধ্যমও বটে। তাই এই মহান পেশার সেবকদের ওপর যখন জুলুম ও নির্যাতন নেমে আসে তখন আমরা ব্যথিত হই। তবে আমরা এর চাইতে বেশি ব্যথিত ও মর্মাহত হই তখন,যখন দেখি কোন সাংবাদিক ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিবেচনায়, অহংকার কিংবা প্রলোভনের কারণে সাংবাদিকতার নীতিমালা এবং কর্তব্যবোধ বিসর্জন দিচ্ছে।
এ মহান পেশা ক্রমান্বয়ে কলুষিত হয়ে আসছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকের স্বাধীনতার নামে এক ধরনের অপসাংবাদিকতার প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আলোর পিছনে অন্ধকার। অর্থলোভী, স্বার্থান্বেষী, টাউট-বাটপারদের যথেষ্ট বিচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে এ মননশীল কর্মচর্চায়। ব্যাখ্যার স্থলে অপব্যাখ্যা ন্যায়কে অন্যায়ের রূপ দান,সত্যকে ঢাকার জন্যে অসত্যের আবরণ ফেলাকে মনে করা হয় সাংবাদিকতার বিজ্ঞতা। সংবাদ লেখার যোগ্যতা নেই অথচ সাংবাদিক। সম্পাদনা করার মেধা নেই অথচ সম্পাদক। এ হচ্ছে সংবাদপত্র জগতের একটি ভয়ংকর চিত্র। এগুলো থেকে অপসাংবাদিকতা বিস্তার লাভ করেছে চারদিকে। আর এই অপসাংবাদিকতার বিকৃত আরেকটি প্রচলিত শব্দ হচ্ছে হলুদ সাংবাদিকতা। হলুদ সাংবাদিকতা কোন সাংবাদিকতা নয়,সেটাকে সাংবাদিকতার মাঝে ফেলা যায় না। তাই হলুদ সাংবাদিকতা একটি বিকৃতি ও সাংবাদিকতার অপব্যবহার। হলুদ সাংবাদিকতার জন্য দায়ী মূলতঃ এক শ্রেণীর সাংবাদিক ও সংবাদপত্র। তবে এর সাথে রয়েছে দেশ ও সমাজের সার্বিক অবক্ষয় । এদের কারণেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাংবাদিক মাত্রই সাধারণ মানুষের কাছে পরিণত হয়েছে এক ভীতিকর প্রাণীতে। মানুষ সাংবাদিক দেখলেই ‘সাংঘাতিক’ বলে আঁৎকে উঠে। কারণ হচ্ছে লেখার স্বাধীনতার সুবাদে এরা ন্যূনতম বিধি-বিধান আর নীতি-জ্ঞানকে তোয়াক্কা না করে রাতকে দিন আর দিনকে রাত করে সংবাদ পরিবেশন করা হয়- এ কেমন সাংবাদিকতা? সত্যকে গোপন করে মিথ্যাকে ফুলিয়ে রং লাগিয়ে প্রচার করাটা সাংবাদিকতার কোন স্তরে পড়ে কি? সংবাদ পরিবেশনায় এক দেশদর্শীতা আর তিলকে তাল বানানোর কেরামতি অবশ্যই সচেতন পাঠক সমাজ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে এটা স্বাভাবিক । অনেক সময় সাংবাদিকতার লেবাস পরে অনেকে কত যে নীচতা,হীনতা,দীনতা আর সংকীর্ণতায় আকন্ঠ নিমজ্জিত তা বলতেও লজ্জা হয়। একজন সাংবাদিক যদি এটা ভাবেন আমি সাংবাদিক,আমার হাতে কলম আছে,কাগজ আছে,তাই যা খুশি লিখবো, সবার মাথা আমি কিনে নিয়েছি এমন ভাবা ঠিক নয়। লেখার স্বাধীনতা মানে অন্যের অধিকার,সামাজিক অবস্থান,মান-সম্মানকে উপেক্ষা করা নয়। সংবাদপত্রের যেই স্বাধীনতা মানুষের সকল স্বার্থের পাহারাদার,তার সকল অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানকারী এবং অসহায়ের শেষ কন্ঠ,সেই পবিত্র স্বাধীনতাকে আজ ‘ভেড়ায় ক্ষেত খাওয়ার’ মতো মর্মান্তিক ভূমিকার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা রাজনৈতিক দলের ওপর অসত্য তথ্য আরোপ করা হচ্ছে। ফলে অনেকে সামাজিক রাজনৈতিক বা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে,যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে তা সংবাদপত্রগুলো প্রমাণ করতে পারছে না।
অনেকে বলছেন,সাংবাদিক কিংবা সংবাদপত্রের মালিকরা সংবাদপত্রের যে স্বাধীনতা রয়েছে,সে সুযোগের অপব্যবহার করছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশের সংবাদপত্র সম্পর্কে, মানুষ বিশ্বাস ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে। যে সব সাংবাদপত্র এ ধরনের মিথ্যা,বানোয়াট কিংবা উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ পরিবেশন করে তারা প্রচলিত আইন-কানুন, সংবিধান এক কথায় সমগ্র দেশ ও জাতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছেন।
এই ধরনের সাংবাদিকদের রাজনৈতিক স্বার্থান্ধতা ও অনৈতিক কার্যকলাপের কারণে সাংবাদিকতার মত এ মহান পেশাও আজ প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। এ বিষয়টি সংবাদপত্র জগতের কর্ণধারদের জন্য এক অশনি সংকেত। এমন চিত্র আমরা লক্ষ্য করেছি আমেরিকার মত দেশেও। এক সময় ছিল যখন কালে-ভদ্রে মার্কিন আদালতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলেও পেশাগত মর্যাদার কারণে তাদের সুনজরে দেখা হতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। পেশাগত সততা ও নিষ্ঠা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় এখন মার্কিন আদালতে সাংবাদিকদের আর আগের মত বিশেষ নজরে দেখা হয় না। এখন আদালতে তাদের বিচার হয় এবং শাস্তিও হয়। এই উদাহরণে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় আছে বৈকি।
আজকাল পত্রিকার পাতাতেই সাংবাদিকের অপকর্মের কথা অন্য সাংবাদিক লিখে দিচ্ছেন এবং তা সংবাদ পত্রেই প্রকাশিত হচ্ছে। সর্ব মহল থেকে নিন্দাবাদ শুনতে হচ্ছে। এরপরও কি? এদের অপকর্মের দৌরাত্ম্য কমছে না কমেনি। তাইতো প্রয়োজন জবাবদিহিতার। ইদানীং অবশ্য সাংবাদিকদের জবাবদিহিতার কথা সচেতন মহল থেকে শোনা যাচ্ছে। মূলত: সাংবাদিকদের প্রতিদিন প্রতিনিয়তই পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। জবাবদিহি করতে হচ্ছে জনতার আদালতে। তারপরও কথা থেকেই যায়, সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকরা যেহেতু সমাজের দর্পন। তাই মানুষ চায় তারা সমাজের অন্যদের জন্যে উদাহরণ হবে। তারা অন্যায় করবে না,অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। তারা দুর্নীতি করবে না,দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। মানুষের এ চাওয়া পাওয়ার দুস্তর ব্যবধানের কিছুটা হলেও কমিয়ে এনে সাংবাদিকদের ‘অপকর্মের’ জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা যায় কিনা সম্ভবত ভেবে দেখার সময় এসেছে। ভবিষ্যতের জন্যে,ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে,যারা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে আসবে,তাদের জন্য দায়িত্বশীলতার একটা বিহিত করা একান্ত প্রয়োজন।