জন চন্দ্র সরকার: দিরাই সুনামগঞ্জের দিরাই হাওরের সংস্কৃতির মধ্যে মিশে আছে জল আর জনের সম্পর্ক। বছরের প্রায় আট মাস এখানে পানি। আর চার মাস দিগন্তজোড়া মাঠ। সে সময়টা এখানে কৃষিকাজ হয়। সবুজের মাঝখানে কখনো পানির ঢেউ, কখনো ধানের পাতা বাতাসে দোল খায়। পানি আর সবুজের সমাহার এ দুইয়ের মাঝে বসবাস হাওরাঞ্চলের মানুষের। এরই মধ্যে নানা আচার-অনুষ্ঠানের আনন্দে বেঁচে থাকেন তাঁরা। সেই আনন্দের একটি উপাদান ধামাইল গান। তবে বিশ্বায়ন আর নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রসারে এ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এখন বিলুপ্তপ্রায়। তবে হাওরের ধামাইল রক্ষায় মাঠে আছেন ১৪ জন নারী-পুরুষ। তাঁরা সবাই ধামাইল গানের শিল্পী। তাঁদের মধ্যে ১ জন পুরুষ আর ১৩ জন নারী। তাঁরা ধামাইল গান বাঁচিয়ে রাখতে ‘ললিতা ধামাইল দল’ নামে একটি সংগঠন করেছেন। এ গানের দলের নারী -পুরুষ সবার বয়স ১৪ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে সবাই স্কুল কলেজের ছাত্র -ছাত্রী। প্রথমে একজন গানের কলি গেয়ে শুরু করেন, তারপর সঙ্গী নারীরা গেয়ে ওঠেন। প্রথমে গান কিছুটা ধীরগতিতে শুরু হলেও আস্তে আস্তে নৃত্য এবং গীতের গতি বাড়তে থাকে ধামাইল একটি প্রাচীন ধারার লোকসংগীত। হাওর অঞ্চলেই এ গানের উৎপত্তি। জন্ম, অন্নপ্রাশন, বিয়ে, গৃহপ্রবেশ, বিভিন্ন ধরনের ব্রত, পালা-পার্বণ ও ধর্মীয় সব মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে এ গান পরিবেশিত হয়। বিশেষ ধরনের এ সংগীতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথা কখনো নিচু, আবার কখনো ওপরে তুলে পর্যায়ক্রমে করতালি দিয়ে গানের তালে ঘুরে ঘুরে ছন্দে ছন্দে নৃত্য করা হয়। করতালির সঙ্গে মিলিয়ে সামনে ও পেছনে পা বদল করে বৃত্তাকারভাবে নাচ চলে। নাচের সময় পেছনের পায়ের সামনের ভাগ মাটিতে আর গোড়ালি থাকে ওপরে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ডান ও বাঁ পায়ের বদল ঘটাতে হয়। করতালি দিয়ে গানের তাল রক্ষা করা হয় বলে তেমন বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। তবে দু-একটি বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে এ গানে ঢোল গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠনটির পরিচালক পিকলু সরকার বলেন, ‘ধামাইল গান এ হাওর অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। ভক্তি ও প্রেমের ভাবাবেশে এ গান পরিবেশিত হয়। বিশেষত রাধা-কৃষ্ণের লীলা, মান-অভিমান, বিরহ, বিচ্ছেদ সবকিছুই গানে ফুটিয়ে তোলা হয়। আকাশসংস্কৃতির প্রভাবে এ লোকসংগীত আজ হুমকির মুখে। আমরা উদ্যোগী হয়ে ধামাইল গানকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ ধামাইল শিল্পী তুষ্টি তালুকদার বলেন, ধামাইল আমাদের ভাটি অঞ্চলের ঐতিহ্য, যা বিশেষ করে বিয়ের অধিবাস এবং জামাই স্নানেই একটা সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু এখন ধামাইল গান সারা বিশ্বজুরে রাজ করছে। পুজা পার্বন,সামাজিক অনুষ্ঠান, সবকিছুতেই এখন ধামাইল চায় মানুষ। গীতিকার ও সুরকার মুকুল ঠাকুর বলেন, ‘ধামাইল গান সংরক্ষণ ও মানুষের কাছে তুলতে ধরতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ লোকসংস্কৃতির স্বকীয়তা হারিয়ে যাচ্ছে। আগে যেখানে ধামাইলে শুধু হাতের তালির পাশাপাশি বড়জোর ঢোল-কাঁসর ব্যবহৃত হতো। এখন সেখানে অনেকেই হারমোনিয়াম, বেহালা, বাঁশিসহ অন্যান্য যন্ত্রও ব্যবহার করছেন। এতে অনেক গানের সুর ও কথা পাল্টে যাচ্ছে।’ দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জনাব মাহমুদুর রহমান খন্দকার বলেন, ‘এই ধামাইল সংগঠনটির কথা শুনেছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও মেলায় অংশ নিতে আমরা তাঁদের সুযোগ করে দেব। এ ছাড়া ধামাইল গান টিকিয়ে রাখতে সংগঠনের শিল্পীসহ অন্যান্য শিল্পী ও সহযোগীদের সাধ্যমতো পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে।