ঢাকা সোমবার ৭ই জুলাই, ২০২৫
আলেকজান্দ্রিয়া ছিল বাইজেন্টাইনদের মিশরের প্রাদেশিক রাজধানী। ৬৪১ সালে রাশিদুন বাহিনী এই বন্দরনগরী অধিকার করে। ফলে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে রোমানদের সামুদ্রিক দৌরাত্ম্য ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের অবসান ঘটে এবং ঐ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতা রাশিদুন খিলাফতের দিকে হেলে যেতে থাকে। বিজিত এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় এবং বাজার ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র তৈরি হতে থাকে।
.
মিশরের জনগণ চ্যালসডোনিয়ান ও নন-চ্যালসেডোনিয়ান হিসেবে বিভক্ত ছিল। সম্রাট হেরাক্লিয়াস ছিলেন ক্যালসেডোনিয়ান। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় প্যাট্রিয়ার্ক অব ক্যালসেডোনিয়া ও প্রাইফেক্টাস ইজিপ্টি- উভয় দায়িত্বে সাইরাস-কে নিযুক্ত করেন। সাইরাস সেখানে দশ বছরের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। নন-ক্যালসেডোনিয়ান লোকেরা প্রকাশ্যে প্রার্থনা করতে পারত না এবং তারা ভয়াবহ নির্যাতিত হতো।
.
কপ্টিক পোপ বেঞ্জামিন-১ এই পুরো সময়টাতে লুকিয়ে ছিলেন। সাইরাস তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল। শহরটি রোমানদের গুরুত্বপূর্ণ সেনা ও নৌ ঘাঁটি হিসেবে কাজ করত। শহরে একটি সুরক্ষিত ইম্পেরিয়াল গ্যারিসন ছিল। ৬৩৮ সালে জেরুসালেম এর পতনের সাথে রোমানদের মনোযোগ প্রধানত আনাতোলিয়া ও মিশরে সীমান্তে নিবদ্ধ হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে মিশরকে রক্ষা করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে।
.
৬৪০ সালে মুসলিম বাহিনী মিশরে প্রবেশ করে। বছরের শুরুতে হেলিওপলিসে আইন শামস যুদ্ধে বাইজেন্টাইন সামরিক শক্তি ধ্বংস হয়। এরপর ব্যাবিলনে দুর্গে বাইজেন্টাইন রক্ষকদের বিরুদ্ধে বিজয় কার্যকরভাবে মিশরে বাইজেন্টাইন শক্তিকে ভেঙে দেয়। ফলে, আলেকজান্দ্রিয়া শহর কার্যত প্রতিরক্ষাহীন হয়ে পড়ে। তবে, আলেকজান্দ্রিয়ার আর্টিলারি মুসলিমদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট ছিল।
.
৬৪১ সালের সেপ্টেম্বরে সাত মাসের অবরোধের পর উবাদাহ ইবনে সামিত ও জুবায়ের ইবনে আওয়াম (রাঃ) এর ভয়ানক আক্রমণে বাইজেন্টাইনদের প্রতিরক্ষা চূর্ণ করে দেয়। বুদ্ধিমান কমান্ডার উবাদা (রাঃ) ঐ দিনই আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রবেশ করেন এবং দারুণ কৌশল প্রয়োগ করেন। তিনি আগেই গভীর পরিখা খনন করে রেখেছিলেন। এবার তার ভিতরে তার সৈন্যদের ও ঘোড়াগুলো লুকিয়ে রাখেন।
.
এই পরিখার বিষয়টি আলেকজান্দ্রিয়ার বাইজেন্টাইন রক্ষকরা জানতে পারেনি। ব্যাবিলন যুদ্ধ শেষ করেই তিনি এবং ঊর্ধ্বশ্বাসে আলেকজান্দ্রিয়া উপকণ্ঠে পৌঁছে যান এবং আকস্মিকভাবে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করার জন্য পরিখায় লুকিয়ে থাকা বাহিনীকে সংকেত দেন। শক্তিশালী এক হামলাতেই আলেকজান্দ্রিয়া গ্যারিসনকে সফলভাবে পরাস্ত করা হয়। ৬৪১ সালের ৮ নভেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
.
তখন মিশরের ফুসতাত নগরী ও মসজিদে আমর ইবনুল আস নির্মাণ করা হয়। আলেকজান্দ্রিয়া নগরী বাইজেন্টাইনদের হাতছাড়া হওয়ার ঘটনার প্রভাব সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অনুভূত হয়েছিল। মিশর থেকে রোমান সম্রাজ্যের বিশাল শস্যের চালান হতো; সেটা বন্ধ হয়ে যায়। দামেস্ক ও আলেকজান্দ্রিয়ার বণিকদের থেকে বিপুল রাজস্ব হারিয়ে সম্রাজ্য অর্থনৈতিকভাবে নিদারুণ দুর্বল হয়ে পড়ে।
.
এমন দুর্বল অবস্থায় টিকে থাকার জন্য রোমান সাম্রাজ্য সমুদ্রে জলদস্যুতা, বণিক জাহাজ আক্রমণ ও তাদের পণ্যসম্ভার “রিকুজিশন” করতে শুরু করে, যা ইউরোপে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহাসিকভাবে, আলেকজান্দ্রিয়া রাজস্ব, খাদ্যশস্য ও বিলাসবহুল দ্রব্য বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যে সরবরাহ করত। কিন্তু উচ্চ করারোপের কারণে শহরটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হইয়নি। এখন তার সমাধান হয়ে গেল।
.
মুসলিম অধিকার থেকে আলেকজান্দ্রিয়া পুনরুদ্ধারের জন্য বাইজেন্টাইন স্টুয়ার্ডশিপ থেকে অনেকবার প্রচেষ্টা করা হয়। এগুলোর কোনটিই সফল হয়নি। তবে, ৬৪৫ সালে বাইজেন্টাইন কমান্ডার ম্যানুয়েল এর নেতৃত্বে বাহিনী সুবিশাল এক নৌবহর পাঠিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য শহরের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল। মুসলিম বাহিনীর অনুপস্থিতিতে মিশরীয় অনেকাংশ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
.
অভিজ্ঞ সেনাপতি আমর ইবনুল আস (রাঃ) অবিলম্বে ১৫,০০০ সৈন্যের বাহিনী প্রস্তুত করে শহরটি পুনরুদ্ধার করতে রওনা হয়। বাইজেন্টাইনরা তাদের ঐতিহ্যবাহী কৌশল হিসেবে দুর্গ থেকে বেরিয়ে উন্মুক্ত প্রান্তরে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হয়েছিল। মুসলিম বাহিনীর তীরন্দাজদের তীব্র তীরবর্ষণে বাইজেন্টাইন বাহিনী বহুদুর পিছিয়ে যায়। অবশেষে মুসলিম অশ্বারোহীদের হামলায় তারা কেবল নিহতই হতে থাকে।
.
বাইজেন্টাইনরা সম্পূর্ণ পরাজিত হয় এবং আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সরে যায়। ৬৫৪ সালে তারা আলেকজান্দ্রিয়াকে ফিরিয়ে নিতে সর্বশেষ চেষ্টা চালায়। সম্রাট কনস্ট্যানস ২ এর প্রেরিত বাহিনী এখানে পরাজিত হয়েছিল। আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি নতুন নেতৃত্বের অধীনে দ্রুত উন্নতি করতে থাকে। স্থানীয় জনগণ মুসলিম গভর্নরদের শাসনের ভালবাসতে শুরু করে, যদিও তারা ধর্মে পূর্ববর্তী শাসকদের অনুসারী ছিল।
আপনার মতামত লিখুন :