আশিকুর রহমান,কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি : চিলমারী কমিউটার। সকাল সাড়ে আটটায় মাত্র চারটি বগিতে টইটম্বুর যাত্রী নিয়ে চিলমারীর রমনা রেলস্টেশন ছাড়ে। বেলা ১১টা নাগাদ পৌঁছায় বিভাগীয় শহর রংপুর। তারপর রংপুর থেকে ফিরে লালমনিরহাট যায়। সেখানে তেল ভরানো হয়, ড্রাইভার বদলি হয় এবং গাড়ি পরিষ্কার করা হয়। তারপর সেটি রাতে কাউনিয়ায় গিয়ে রংপুর এক্সপ্রেসের অপেক্ষা করে। রংপুর এক্সপ্রেসের কুড়িগ্রামের যাত্রীদের নিয়ে কুড়িগ্রাম ফেরে। তারপর কুড়িগ্রাম থেকে রংপুর এক্সপ্রেসের যাত্রীদের নিয়ে আবার কাউনিয়ায় গিয়ে রংপুর এক্সপ্রেস ধরিয়ে দিয়ে রাত ১০ থেকে ১১টায় কুড়িগ্রাম পৌঁছায়।আবার কুড়িগ্রাম থেকে দিবাগত রাত একটা নাগাদ চিলমারী পৌঁছায়। তখন পুরো ট্রেনে যাত্রী থাকে বড়জোর তিন থেকে চারজন। অর্থাৎ পুরো ট্রেন থেকে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী, চিলমারী, উলিপুর উপজেলার যাত্রীরা শুধু একবার সেবা পান। আর কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেসসহ (শাটল) মোট মাত্র তিনটি ট্রেন চলাচল করে এবং যে আন্তনগর দুটি চলাচল করে, তা-ও কুড়িগ্রাম জেলায় একটিমাত্র স্টেশনে যাত্রাবিরতি করে।রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির সাবেক সহসভাপতি প্রভাষক আবদুল কাদের বলেন, ‘চিলমারী কমিউটারটি ওয়াশফিডের জন্য লালমনিরহাটের বদলে সরাসরি পার্বতীপুরে ব্যবস্থা করা হোক। আধা ঘণ্টার ওয়াশফিড শেষে বিকেল চারটায় চিলমারীতে ফিরতে পারবে। তারপর চিলমারী থেকে রংপুর এক্সপ্রেসের শাটল হিসেবে ব্যবহার করা হোক। এতে চিলমারী কমিউটারটি দিনে চারবার কুড়িগ্রামবাসীর সেবায় ব্যবহৃত হবে।’ অর্থাৎ শুধু লালমনিরহাটের বদলে পার্বতীপুরে চিলমারী কমিউটারটি ড্রাইভার বদল, তেল ভর্তি ও ধোয়ার কাজটি করা গেলে কুড়িগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থায় বড় বদল ঘটবে। বিষয়টি নিয়ে কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদারের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করি। তিনি প্রস্তাবটি লিখিতভাবে জানাতে বলেন। এর আগে কুড়িগ্রামের টগরাইহাট স্টেশনে রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির আয়োজনে কয়েক হাজার লোকের জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রংপুর এক্সপ্রেসের শাটল ট্রেনটি আধা ঘণ্টা আটকিয়ে ডিআরএমএর প্রতিশ্রুতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়।যেসব জেলায় রেলপথ আছে, সেগুলোর গড়ে লোকাল ও আন্তনগর মিলে ছয় থেকে আটবার রেলসেবা পাচ্ছে। পঞ্চগড়ে আন্তনগর পাঁচটিসহ ছয়টি, লালমনিরহাটে চারটি আন্তনগরসহ ডেমু, লোকাল ও কমিউটার মিলে আটটি ট্রেন চলাচল করে। নীলফামারী জেলাতেও ছয়টি আন্তনগরসহ মোট আটটি ট্রেন চলাচল করে। রংপুরে ২টি আন্তনগরসহ মোট ১০টি ও দিনাজপুরেও একইসংখ্যক ট্রেন চলাচল করে।কৃষক যদি এক বস্তা মরিচসহ ট্রেনে চড়ে বিনা ভাড়ায়ও দিল্লিতে ঢোকেন, তবে একজন কৃষকের সঙ্গে এক বস্তা মরিচও দিল্লিতে ঢোকে, যা ট্রাকে আনতে গেলে রেলভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি পড়ে। ট্রাকের টায়ার বাঁচে, রাস্তা বাঁচে, ডিজেলের ভর্তুকিও বাঁচে। একজন চাকরিজীবী যদি ৫০ কিলোমিটার দূর থেকে ট্রেনে দিল্লিতে তাঁর অফিসে ঢোকেন, তবে তাঁর এনার্জি, বসবাসের খরচ দিল্লিতে থাকার চেয়ে অনেক বেশি বাঁচে, যা একদিক থেকে দেশের লাভ। একজন চাকরিপ্রার্থী যদি রেলে আসেন, তবে বাসে এসে ইন্টারভিউ দেওয়া ব্যক্তিদের চেয়ে অনেক বেশি ফ্রেশ মুডে ইন্টারভিউ দিতে পারেন। একজন ছাত্র যদি ট্রেনে কলেজ ধরতে পারেন, তবে তিনি অনেক বেশি মনোযোগী হতে পারেন—এমনটাই বলেছিলেন ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব। অথচ ১৯৯০ সালের আগে চিলমারী থেকে চারটি লোকাল ট্রেন চলত। এখন সেই সকালে এক বেলা কেবল যাত্রী ভর্তি হয়ে চিলমারী কমিউটার রংপুর যায়। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে সবচেয়ে গরিব জেলার বাসিন্দাদের জন্য সুলভের বগি নেই। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস চালুর পর সুলভ বগির দাবি করলে রেল কর্মকর্তা বলেছিলেন, বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ। সুলভের বগির দরকার নেই।কেবল খানা জরিপগুলোয় যখন প্রকাশিত হয় কুড়িগ্রামের দারিদ্র্যের শীর্ষে ওঠার খবর, তখন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তাগিদ আসে। কর্তারা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন কারণ। অন্যদিকে রেলকর্তারা কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে সুলভ বগি রাখার দাবি বাতিল করে দেন মধ্য আয়ের দেশের দোহাই পেড়ে। ২০১৫ সালে ১৫ অক্টোবর যখন প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠের জনসভায় আসেন। তখন দলীয় নেতারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ট্রেন, ইপিজেড, নদ–নদী খনন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি উত্থাপন করেননি। কিন্তু স্থানীয় গণকমিটি নামের একটি সংগঠনের নেতাদের সংবাদ সম্মেলন ও জনসভাস্থলে মঞ্চের ঠিক সামনেই ব্যানার তুলে ধরা এবং সৈয়দ শামসুল হক ও তৎকালীন জেলা প্রশাসকের আন্তরিকতার ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে থেকে দাবি চারটি পূরণের প্রতিশ্রুতি দেন।খানা জরিপগুলোয় বারবার গরিব জেলার উপাধি পেয়েছে কুড়িগ্রাম জেলা। রাষ্ট্রের গরিবতম জেলার বাসিন্দারা রাষ্ট্রের সবচেয়ে কম সুবিধা পায়। কুড়িগ্রাম জেলায় দলীয় ভাগ–বাঁটোয়ারায় সংসদ সদস্য হন বাস মালিক সমিতির নেতা। কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা এসে কাউন্সিল ছাড়াই ঠিক করে দিয়ে যান সভাপতি ও সেক্রেটারির নাম। ফলে এই নেতারা কেমন করে লালু প্রসাদ যাদবের মতো জানবেন, রাজারহাটের সুপারি ও লটকন, দুর্গাপুরের চাটাই, চিলমারীর জোড়গাছহাটের মসলা ও কলাই রংপুর ও ঢাকায় না গেলে কর্মসংস্থান ও বৈচিত্র্যময় ফসলের আবাদ বন্ধ হয়ে যাবে। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে মঙ্গা বারবার ফিরবে।
আপনার মতামত লিখুন :