ঢাকা মঙ্গলবার ৮ই জুলাই, ২০২৫
“ইন্দুবালা ভাতের হোটেল” মূলত স্মৃতিজীবিতার গল্প। শ্রীমতী ইন্দুবালা মল্লিক মূলত অতীতাশ্রয়ে বেঁচে থাকা একজন মানুষ। বিবাহপূর্ব জীবনের সংক্ষিপ্ত সুখময় সময়টির চিন্তার ভেতরেই তিনি আজীবন পরিভ্রমণ করেন।
উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে এবং ওয়েব সিরিজটি দেখতে গিয়েও আমার বারবার মনে হয়েছে ইন্দুবালা ভিন্ন গ্রহের মানুষ। অতীতস্মৃতিকে সহজেই ভাবনা থেকে সরিয়ে ফেলে বর্তমানের আনন্দ ও দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত আমি স্মৃতিবিলাসী ইন্দুবালাকে ঠিক চিনতে পারি না, বুঝতে পারি না। একটা মানুষ কী করে এমন অতীতে বাঁচে!
অবশ্য প্রায় বাঙালি নারীর জীবনই এমন। বিবাহপূর্ব জীবনের স্বাধীনতার সুখ-রোমন্থনটুকুই তার সব। ইন্দুবালাও ব্যতিক্রম নন। তবে তার দুর্ভাগ্য যে বিয়ের সাথে সাথে পরিবার এবং দেশও হারিয়েছিলেন, পরগৃহে পরদেশে পরবাসী জীবনে নতুন করে শেকড় গাঁথা তো সহজ ছিল না।
ইন্দুবালাকে আমরা দেখি ভালো মানুষ হিসেবে। অন্যায় কথার প্রত্যুত্তরেও যিনি কখনো কিছু বলেননি। নীরবে ভিত গড়েছেন নিজের। তবে আইকনিক ইন্দুবালাকে আমার অত করিৎকর্মা মনে হয়নি, তিনি আটপৌরে। ইন্দুবালার সাথে আমার চিন্তার অত সখ্য হয়নি৷ বরং মাছওয়ালী লাছমিকে আমার চেনা লাগে। মেয়েটা কী দুরন্ত সুন্দর আর সৃজনশীল! ইন্দুবালার শেকড় গাঁথার আসল নায়ক লাছমি!
ইন্দুবালা ভাতের হোটেল উপন্যাসে আমার কিছু বিরক্তি এসেছিল যখন দেখেছি লেখক বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধকে বারবার গুলিয়ে ফেলছিলেন। উপন্যাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়গুলো নিয়ে আরো পড়াশোনা করা উচিত লেখকের। ব্যাসিকে এত গড়বড় হলে তো সমস্যা! গড়বড় করেছেন পরিচালকও ভাষা নিয়ে! খুলনার কলাপোতা গ্রামের ইন্দুবালা ও তার পরিবারকে যে ভাষায় কথা বলানো হয়েছে সিরিজে, তা কোনোভাবেই খুলনার ভাষা নয়, বড়জোর মুন্সিগঞ্জের ভাষা হতে পারে। এপার বাংলা নিয়ে আসলেই তারা বড় কম জানেন!
শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় অভিনয় বড় নজর কেড়েছে। কী সুন্দর মানিয়ে গেলেন তরুণ, মধ্যবয়স্ক এবং বৃদ্ধ ইন্দুবালার চরিত্রেও! আর লাছমি চরিত্রে স্নেহা চট্টোপাধ্যায় তো রীতিমতো আটকে ফেললেন দর্শককে। লাছমি যতক্ষণ স্ক্রিনে ছিল, আমি তো চোখের পাতাও ফেলতে পারছিলাম না!
সিরিজের আবহ, আলোর খেলা আর ছেনু মিত্তির লেনের বাড়ির জন্য সেট তৈরি করা হয়েছে, তা বড় মনোহর। শান্তি পেয়েছি সিরিজটা দেখে। আসলে ওয়েন সিরিজে মুহুর্মুহু রক্তারক্তি, মানসিক চাপ, থ্রিল এসব দেখতে দেখতে আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। এরপর টানা দেখলাম বল্লবপুরের রূপকথা, একান্নবর্তী এরপর এই ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। এসব আমাকে শান্তি দিল।
সবচেয়ে শান্তি দিল ইন্দুবালা ভাতের হোটেল সিরিজের এই গানটা –
পাখিদের স্মৃতি কিছু রীতিনীতি
ফণীমনসা ও জানে,
বাগানের স্মৃতি নজরুল গীতি
বালিকার কানে কানে।
বিকেলের স্মৃতি গোপন পিরিতি
গোপনেই রাখা থাকে,
মানুষের স্মৃতি বহু বিস্মৃতি
শ্মশান বন্ধু টানে।
ঘন মেঘে ঢাকা সুহাসিনী রাকা
তুমি কি গো সেই মানিনী,
অসাড় আষাঢ়ে অকুল পাথারে
স্মৃতির ও বিলাসে ভাসিনি,
ঘন মেঘে ঢাকা ..
কাঁটার মুকুটে ঈশ্বর প্রীতি
নদীর দুকূলে নৌকোর স্মৃতি,
অ্যালবাম জুড়ে অচেনা মুখেরা
তারাও তো ছিল কারুর স্মৃতিতে,
অসীম বন্ধুপ্রীতি,
ক্ষিদের স্মৃতিতে খুদের গন্ধ
প্রাচীন অর্থনীতি।
বৃষ্টির স্মৃতি যুদ্ধ বিরতি
ভিজে ওঠে অবরোধে,
রাস্তার স্মৃতি সারমেয় ভীতি
জেগে থাকে অপরাধে।
তোমার যাওয়ার পথ ভরেছে
স্মৃতিদের হাহা রবে,
বহু রাত একা জেগেছে প্রকৃতি
চোরের উপদ্রবে।
আপনার মতামত লিখুন :